প্রফেসর গোলাম আজমের গ্রেফতারঃ একজন দৌহিত্রীর চোখে
৭ ই ফেব্রুয়ারী ২০১২
বাংলাদেশে একজন শীর্ষ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের গ্রেফতার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে কিভাবে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া অতীতের বিচার কত সহজেই বর্তমানের রাজনৈতিক কূটকৌশলের হাতিয়ার হয়ে যেতে পারে
জানুয়ারীর ১১ তারিখ, বিস্ম্য় মেশানো হতবিহবলতা নিয়ে দেখছিলাম কিভাবে কর্তৃপক্ষ আমার দাদা প্রফেসর গোলাম আজমকে–যাঁর বয়স দাঁড়িয়েছিল তখন ৮৯, কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল। ৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত ৬২ খানা স্বকল্পিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হল। এরমধ্যে এই অদ্ভুত অভিযোগও ছিল যে তিনি “মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশে সংঘটিত সকল হাঙ্গামার” জন্য দায়ী ব্যাক্তি।
কর্তৃপক্ষ জামিন আবেদন খারিজ করে দিয়ে প্রফেসর গোলাম আজমকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাচ্ছে ডেমোটিক্স/মারারশিড, সত্ত্ব সংরক্ষিত
যুদ্ধের সময় আমার দাদা যে দলটির নেতা ছিলেন সেটি ছিল একইসাথে পূর্ব পাকিস্তানের সবচাইতে বড় ইসলামী আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে সে সময়ে বড় পরিসরে প্রভাবহীন একটি ছোট দল। তিনি চেয়েছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একসাথে থাকুক, তবে তিনি সামরিক অভিযান এবং সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলোর নিঃশর্ত ও নিরংকুশ বিরোধী ছিলেন। এই পারস্পরিক
লড়াইয়ের মাঝে ক্রসফায়ারে পরে যাওয়া মানুষকে বাঁচানোর নিরন্তর চেষ্টা তিনি করেছেন। সংঘাত প্রশমনে সেসময়ে তার সর্বান্তকরনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তান আর্মি এবং আধাসামরিক বাহিনী যেসব অপরাধ করল সেগুলোর জন্য তাকে বলির পাঁঠা বানানো হল। একটি প্রলম্বিত ও সদা তৎপর মিডিয়া কুৎসার প্রচার প্রসারের মাধ্যমে তাঁকে দানবিক এক মূর্তি দেওয়া হয়েছে যেটা অনেককে এমন এক ব্যাক্তির ব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্তে উপনিত করেছে যাদের জন্ম যুদ্ধের পরে এবং যারা কখনও তাঁর সাথে দেখা করেনি।
আমার দাদা যে রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশে গড়ে তুলেছেন, সেটি এখন দেশের অন্যতম বৃহৎ বিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন এবং আরেকটি বড় দলের সাথে জোটবদ্ধ। এই ব্যাপারটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন শাসকগোষ্ঠীর জন্য একটা বাস্তব রাজনৈতিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাসকগোষ্ঠী যুদ্ধাপরাদের বিচারের নামে ভিন্নমতের নির্মূলে একটি সর্বাত্নক সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যে আন্তর্জাতিকতার দাবী করে সেটার “আ” -ও সে ধারন করেনা। যারা অভিযুক্তদের শুধু সমর্থন করেন তাদেরকেও ক্ষমতাসীন উচ্চপদস্থ মহারথীরা গ্রেফতার যোগ্য অপরাধী সাব্যস্ত করেন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চেয়ারম্যান (তৎকালীন) নিজেই নব্বই এর দশকে আইনবহির্ভূতভাবে গঠিত গন তদন্ত কমিশন এর মেম্বার হওয়ার মাধ্যমে এই মামলার একটি পক্ষ হয়ে গিয়েছেন। এই গন তদন্ত কমিশন আবার আইনী প্রক্রিয়া এবং এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে আমার দাদাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। এসব কিছু হচ্ছে এমন এক সময় যখন বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপ গুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রায় বছর দুই ধরে বিচারের আগেই কারাভোগ করছেন, নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছেন। একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের অনেক ব্যাক্তি যাদের বিরুদ্ধে বিহারী নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গনহত্যার প্রমাণ রয়েছে, তারা এই বিচার প্রক্রিয়া থেকে দায়মুক্তি উপভোগ করছেন। ফলে সুবিচারের প্রশ্নটি সম্পূর্ন উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। সাংবাদিক থেকে আন্তার্জাতিক আইনবিদ –বহু ব্যক্তি এই ট্রাইবুনালের আইনি ফারাক, প্রক্রিয়ার ভুলত্রুটি এবং সুবিচার নিশ্চিত করার চাইতে প্রতিশোধ গ্রহনের প্রচ্ছন্ন খায়েশের কড়া সমালোচনা করেছেন। এমনকি জাতিসংঘ ছয়জন মূল সন্দেহভাজনের গ্রেফতারে ধিক্কার দিয়েছেন এবং বলেছেন যে এটি তাদের মানবাধিকারের লংঘন।
যদি এই বিচার একটি আন্তর্জাতিক আদালত, যেটি যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া মেনে চলে এবং সুবিচার নিশ্চিত করে, যেমন দি হেগ –এ হত তাহলে আমাদের পরিবারের এতে কোনো আপত্তি বা দুশ্চিন্তার কিছু ছিলনা। একটা ট্রাইবুনাল চলুক- এই ব্যাপারটা আমরা কোনোভাবেই বিরোধিতা করিনা; আমাদের একমাত্র দাবী হচ্ছে এই প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ ও ন্যায়মূলক হোক। অথচ সুবিচার নিশ্চিতের দাবী তোলা হলেই খুব উদগ্র আবেগের সাথে সেটাকে “বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে” বলে ঠাওরানো হয়।
এই ব্যাপারটা বাংলাদেশে চলমান আরো বড় একটা পরিবর্তনের ইংগিত দেয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়মিতভাবে খর্ব করা হচ্ছে। এই ব্যাপারটা সরকারের বড় সমর্থকরাও কি অস্বীকার করতে পারবেন? ট্রাইবুনাল বা সরকারের যেকোনো সমালোচনা খুব দ্রুত যথাযথ শাস্তি দিয়ে জবাব দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ দাঁড়া করিয়ে দেশে মত প্রকাশের উপর সরকারের খড়গহস্ত হওয়ার প্রবনতাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এমন এক ট্রাইবুনাল যেটি যেকোনো আইনি পর্যালোচনার মুখেই বালির
বাঁধের মত ভেসে যাবে –সেটিকে জিইয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় এই সরকার এমনকি যেসব সিনিয়র বিদেশি এসব অবিচারের বিরোধিতা করেছেন তাদেরও ছাড়েনি। টবি ক্যাডম্যান, যিনি একজন আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ ব্যারিস্টার –তাকে সরকার বাংলাদেশে ঢুকতে বাধা দিয়েছে এবং তার গঠনমূলক সমালোচনার জন্য তার নামে কুৎসা রটিয়েছে।
জানুয়ারির ৯ তারিখের শুনানিতে আমার দাদার ব্যারিস্টারকে জানানো হয়েছিল যে ১১ তারিখ দাদাকে সশরীরে কোর্টে হাজির হতে হবে অথবা তাকে গ্রেফতার করা হবে। অথচ, কোর্টে হাজির হওয়ার পরও তাকে সেই গ্রেফতারই তো করা হোলো। গত দু বছরে চালানো মিডিয়া প্রপাগান্ডার সময়ে যিনি বিন্দুমাত্র কোনো এড়িয়ে যাওয়া বা লুকোছাপা করার কোনো নজির দেখান নি, সেই ৮৯ বছর বয়সী হাটাচলায় অক্ষম ব্যাক্তি -পালিয়ে যেতে পারেন এমন সন্দেহের কারনে তাকে গ্রেফতার করা হল। বয়স এবং ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের কারনে জামিন চাওয়া হয়েছিলঃ প্রথমে সেটা মঞ্জুর হলেও খুব দ্রুতই সেটা বাতিল করা হল।
সরকারী দলের ভেতরের ঘাপটি বামপন্থীরা আমার দাদার বিরুদ্ধে চলা কর্মযজ্ঞে এক সুবিশাল শক্তিশালী গ্রুপ। ব্রিটেনে একজন ছাত্রী অ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে বহু বছর আমি যেসব পশ্চিমা সমাজতন্ত্রীদের সাথে কাজ করেছি তারা আন্তর্জাতিকভাবে চলমান মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার আন্দোলনের জন্য মূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছেন। কিন্তু, কেন বাংলাদেশের বামপন্থীরা সুবিচার প্রতিষ্ঠার আগ্রহ রাখেন না বরং কেন তাদের আগ্রহ যেভাবেই হোক ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়ার দিকে –এই ব্যাপারটা তারা আসলে কোন ধরনের সমাজতন্ত্রের তকমা ব্যবহার করেন সে সম্পর্কে আমাকে দোদ্যূলমান করে তুলেছে।
বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক দল গোলাম আজমের ফাঁসি চেয়ে ঢাকায় শোভাযাত্রা বের করেছে
ডেমটিক্স/বায়োজিদ আকতার, সত্ত্ব সংরক্ষিত
শাসকগোষ্ঠী যে আপাত দৃষ্টিতে ৭১ এর যুদ্ধের সময় ঘটা অপরাধের ব্যাপারে একটা ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে চান সেটা বর্তমান সময়ে দেশে ঘটা নৃশংস অপরাধ এর দায়মুক্তি দেখলে নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। ২০০৯ সালে বিডিয়ার হেডকোয়ার্টারে ঘটা হত্যাযজ্ঞের ঘটনাটা একটা সহজ ও জ্বলন্ত উদাহরন। বহু চৌকস আর্মি অফিসার নৃশংসভাবে সেখানে খুন হলেন, তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হলো। দশকের পর দশক ধরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর্মির এসব চৌকষ মেজর ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেলদের হারানো বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭১ এর বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ডের মতই একটা সুগভীর বেদনাময় ক্ষত। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু মীমাংসা হয়নি, এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানানো হলে সেটাকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং এর বিচারিক প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ। ক্ষুদ্রাকৃতির এবং সীমিত পরিসরে যেভাবে এসব বিচার সাময়িক আদালতে ধীরলয়ে চলেছে সেটাকে জাতীর বিরুদ্ধে ঘটানো এরকম জঘন্য একটা অপরাধের বিরুদ্ধে একটা দায়সারা তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিক্রিয়া ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। যেসব শোকাতুর আর্মি অফিসাররা তাদের সতীর্থদের হত্যার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন মাত্র তাদেরকে আর্মি থেকে খুব ত্বরিৎ গতিতে বিতারন করা হয়েছে। পুলিশের নৃশংসতা এবং জেলহাজতে মৃত্যু বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গিয়েছে এবং আন্তার্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের ডিফেন্স আইনজীবিদের কে হয়রানি করার মত ঘটনাগুলো হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং আরো অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন গুলো তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ এরকম একমাত্র দেশ যে শুধু মৃত্যুদন্ড ব্যবহারই করেনা বরং এর ব্যবহারকে সম্প্রতি ছড়িয়ে দিয়েছে।এর সাথে যোগ হয়েছে সর্বব্যাপী ঘৃণার ক্যাম্পেইন, যেখানে গা শিউরানো সব গ্রাফিক পোস্টার ব্যবহার করে সারা দেশকে ফাঁসিময় করে তোলা হয়েছে। এখানে ট্রাইবুনালের রায় একটা বাহুল্য মাত্র হয়ে গিয়েছে। অবিচার এবং অন্যায্য বিচারের ভয় এখন নিত্য বাস্তবতা এবং ভয়াবহভাবে দুঃশ্চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবশেষ যে বার পরিবারের পক্ষ থেকে দাদাকে দেখতে যাওয়া হয়েছিল সেটা ছিল নামেমাত্র একটা আধাঘন্টার সাক্ষাত যেখানে ১১ জন আইনশৃংখলা বাহিনীর লোকেরা এবং কয়েকটা সিসিটিভি ক্যামেরা আমাদের ৪ জন কে সার্বক্ষণিক নজরদারীর মধ্যে রেখেছিল। আমার দাদা জেল খানার বেডে শুয়ে ছিলেন। জীবনে আর কখনও এত দূর্বল অবস্থায় তাঁকে আমি দেখিনি, তবুও তার চোখে আর মৃদু উচ্চারিত শব্দে ছিল জীবনের উচ্চারন, এগিয়ে যাবার সোৎসাহ। আমার মনে পড়ছিল গ্রেফতারের আগে নেতাকর্মীদের প্রতি তার সর্বশেষ বাণী যেখানে তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করাকে তার নিজের জীবনের উপরে প্রাধান্য দিতে বলেছিলেন, এবং আইন মেনে চলতে বলেছিলেন। আমরা যখন উদ্বিগ্ন তখন তার এই উচ্চারন ছিল শত প্রতিকূলতার বিপরীতে তাঁর সাহস, দেশের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি এবং তাঁর আধ্যাত্নিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ। আমার দাদা সবসময় ছিলেন খুব সোজাসাপ্টা সৎ মানুষ। তিনি তাঁর নীতির প্রতি, তাঁর দেশের সম্ভাবনার প্রতি সবসময় পর্বতপ্রমান অবিচল ছিলেন। তিনি যেভাবে তার জীবন কে তাঁর উদ্দেশ্যের প্রতি ওয়াকফ করে দিয়েছেন সেটা আমি আমার জীবনে আর কারো মধ্যে দেখিনি। জেলখানার গরাদের ওপাশে বন্দি এই ব্যাক্তির
মধ্যে যে অটুট অপরিবর্তিত প্রাণশক্তি আমি দেখেছি তাতে আমার বিশ্বাস প্রগাঢ় হয়েছে যে একজন আদর্শবাদী
মানুষকে আসলে পরাজিত করা সম্ভব না।