সামছুল আরেফীন, দৈনিক সংগ্রাম
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আটক মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লাকে আটক রাখার প্রক্রিয়া আইনসম্মত হয়নি বলে অবিলম্বে তাদের মুক্তি দিতে বাংলাদেশ সরকারকে আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। আটককৃতদের অধিকার হরণ, প্রয়োজনীয় তথ্য না দেয়া এবং জামিন দেয়ার বিধান বন্ধ করে দেয়াকেও আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির পরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছে তারা, এ অবস্থার অবসানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানায়। এ ব্যাপারে মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অরবেটরী ডিটেনশন এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয়া হলেও তাদের তথ্য দেয়া হয়নি বলে তারা তাদের চিঠিতে উল্লেখ করেন। ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অরবেটরী ডিটেনশন-এর সেক্রেটারি মিগুল ডি লা লামা এ চিঠি দেন।
ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে বাংলাদেশকে এই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই করতে হবে। কেননা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এর Rome statute এর সমর্থনকারী দেশ।
ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অরবেটরী ডিটেনশন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের রেজুলেশন ১৯৯১/৪২ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়াকিংর্ গ্রুপের কার্যক্রম নিয়ে আরেকটি রেজুলেশন হয় যার নং ১৯৯৭/৫০। ২০০৬ সালে মানবাধিকার কাউন্সিলের কার্যক্রম অনুমোদিত হয় যার নং ২০০৬/১০২। ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর আরো ৩ বছরের জন্য তা বাড়ানো হয়। যার রেজুলেশন নং ১৫/১৮।
বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আটককৃতদের অবস্থা জানতে চেয়ে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন অরবেটরী ডিটেনশন-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দেয়া হয়। কিন্তু ওয়ার্কিং গ্রুপকে সরকার প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়নি। চিঠিতে নির্দিষ্ট সময় দিয়ে বলা হয়েছিল, এর মধ্যে তথ্য না দিলে তারা নিজেরাই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদের মতামত দিবে। সরকার সাড়া না দেয়ায় ওয়ার্কিং গ্রুপ নিজেরাই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে তাদের মতামত চূড়ান্ত করে।
ওয়ার্কিং গ্রুপের চিঠিতে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচারসহ বাংলাদেশ সরকার সব জায়গায়ই মানবাধিকার নিশ্চিত করায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সহযোগিতা চেয়েছেন বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিকমান রক্ষা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এ ব্যাপারে প্রস্তাব পাস করেছে। বাংলাদেশ সরকার বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ ও রাজনৈতিক সম্প্রীতির সংস্কৃতি উন্নয়ন করতে চায়। (এ/এইচআরসি/১১/১৮, প্যারা-১৫)
এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশে দেশীয় আইনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৬ জনের বিচার প্রক্রিয়া চলছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে এই বিচার প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই বাংলাদেশকে করতে হবে। কেননা বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) এর Rume statute-এর সমর্থনকারী দেশ। এ অনুযায়ী যুগোস্লাভিয়া ও রুয়ান্ডার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং অন্যান্য ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়েছে।
এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিধি ও মামলার উদাহরণ দিয়ে বলা হয়, বিচারপূর্ব আটক করে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের অধিকার হরণ করেছে।
ওয়ার্কিং গ্রুপ দীর্ঘ আলোচনা শেষে তাদের অভিমত দিতে গিয়ে বলে, আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের আইনী সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অধিকার দারুণভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। ডিফেন্স পক্ষের আইনজীবীদের আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের সময় থাকতে দেয়া হয়নি এবং তাদেরকে অভিযোগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্যও দেয়া হয়নি। ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে, ডিফেন্স আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং বিচারপূর্ব আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করতে না দেয়ায় আইসিসিপিআর-এর আর্টিক্যাল ৯(২) এবং ৯(৪) আর সাধারণ আইনের মূলনীতির পরিপন্থী।
বিচারের পূর্বে ১ বছরের ও অধিক সময় আটকে রাখা আত্মপক্ষ সমর্থনকারীদের প্রয়োজনীয় তথ্য না দেয়া আইসিসিপিআর-এর আর্টিক্যাল ৯(২) এবং ৯(৩)-এর পরিপন্থী। সরকার এ ব্যাপারে অব্যাহতভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকার তাদের জামিন না দেয়ার ব্যাপারে কোন যৌক্তিক কারণও দেখাতে পারেনি। ওয়ার্কিং গ্রুপ মনে করে তাদের এভাবে আটক রাখা সম্পূর্ণ অন্যায় ও অযৌক্তিক।
চিঠিতে বলা হয় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী স্বেচ্ছাচারিতার শিকার বলে সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ আর্টিক্যাল-৯ এবং আইসিসিপিআর-এর আর্টিক্যাল-৯ অনুযায়ী ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছে আবেদন করেছে।
ওয়াকিংর্ গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারকে আইসিসিপিআর এবং সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী তাদের অবস্থার অবসান ঘটাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অভিমত জানায়।
উল্লেখ্য, জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার বিষয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক আটক রয়েছেন। এর মধ্যে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম এ বছরের ১১ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনালের আদেশে আটক রয়েছেন। বিএনপি নেতা আবদুল আলীম জামিনে রয়েছেন।